আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
গত সপ্তাহে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে লিবিয়া। পূর্ব লিবিয়ার সবুজ পর্বতশ্রেণিতে হামলে পড়েছে প্রচণ্ড ঝড়। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। অর্ধ-শতকের পুরনো প্রায় অরক্ষিত দুটি বাঁধ জলের ঢল সামাল দিতে পারেনি। ১১ সেপ্টেম্বর ভোর ৩টার ঠিক আগমুহূর্তে প্রথম বাঁধটি ধসে পড়ে। উপকূলীয় শহর দেরনাকে দ্বিখণ্ডিত করে বয়ে চলা নদীর তলদেশ থেকে ফুঁসে ওঠে পানির আরেকটি বিশাল প্রাচীর। আট মাইল ভাটিতে যে দ্বিতীয় বাঁধ আছে, জলোচ্ছ্বাসটি তার পাদদেশে সামান্য সময়ের জন্য গিয়ে থামে। তারপর প্রবল বেগে জেগে ওঠে। বাঁধ এবং আশপাশে যা আছে সব ভাসিয়ে নেয়। সকাল হতে হতে শহরের এক-তৃতীয়াংশ ভেসে যায়, নিখোঁজ হয় হাজার হাজার প্রাণ। ধ্বংসাবশেষ রেখে যায়। স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, মৃতের সর্বনিম্ন সংখ্যা হবে ১১ হাজার। তবে সংখ্যাটা দ্বিগুণও হতে পারে।
পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে
যা ঘটেছে লিবিয়ার বেশিরভাগ মানুষের মতে এটা বন্যা নয় সুনামি। তারা ধরতে চেষ্টা করছে এই ধ্বংসের ভৌত কারণ ও শক্তির উৎসটা কী ছিল। দেরনার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আটকা পড়েছে প্রায় ১ লাখ বাসিন্দা। গৃহহীন হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এলাকার অন্যান্য বাঁধও ভেঙে পড়তে পারে। যদিও এখন সমুদ্র শান্ত। বাঁধের অবশিষ্টাংশই কেবল বাকি আছে। তবে তীরে এখানে সেখানে মৃতদেহ ভেসে উঠছে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে লাশের পচা গন্ধ। দেরনায় উদ্ধারকারীরা বলেছেন, গত সপ্তাহে যে মানুষগুলো স্রোতে ভেসে গিয়েছিল, তাদের লাশ এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে সাগরে ভেসে উঠছে। তুরস্কের একটি দল জানিয়েছে, তারা শনিবার সকালেও পানি থেকে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ তুলেছেন। তবে উদ্ধারকারীরা সংখ্যায় যথেষ্ট নয় এবং রয়েছে সমন্বয়ের অভাব, ফলে উদ্ধার তৎপরতা চলছে মন্থর গতিতে। যারা আহত এবং গৃহহীন হয়ে পড়েছেন তাদের জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানি না থাকায় বেঁচে যাওয়া মানুষের জীবন নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাঁধ কেন ভেঙে গেল?
বাঁধের নকশা এবং সুরক্ষা নিয়ে গবেষণা করেছেন, এমন একজন হলেন আফ্রিকার জলসম্পদ ও প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ নাধির আল-আনসারি, তিনি বলেছেন, বাঁধটি কীভাবে তৈরি করা হয় তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাঁধ নিরাপত্তার যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে কি না। যেমন, ঝড়ের সময় প্রকৌশলীদের উচিত বাঁধ উপচে যেন না পড়ে, তাই আগে ভাগে স্লুইস গেট খুলে পানি ছেড়ে দেওয়া। তিনি দ্য কনভার্সেশন ডট কমকে বলেছেন, ‘লিবিয়ার বাঁধগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো ছিল না। দায়িত্বশীল প্রকৌশলীর উচিত ছিল, পানি যেন বাঁধের ধারণ ক্ষমতার বেশি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা। অব্যবস্থাপনাই দেরনার বাঁধ ধসে যাওয়ার প্রধান কারণ।’ যদি বাঁধ পরিচালনাকারী দায়িত্বশীলরা পানি ছাড়ার জন্য গেট খুলে দিতেন, বাঁধের পানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা যদি ভারী বৃষ্টিপাতকে উপেক্ষা না করতেন, তাহলে বিপর্যয় এড়ানো যেত। তাছাড়া আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং বাঁধগুলো পরিচালনাকারী প্রকৌশলীদের মধ্যে যোগাযোগেও সমন্বয় ছিল না বলে জানা গেছে। তা ছাড়া বাঁধের নিচের দিকের এলাকাগুলো আবাসনের জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। দুর্গতদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, পানির স্তর বেড়ে গেলে সরকারি কর্মকর্তাদের একদল বলেছেন বাড়িতে থাকতে, আবার সেনাসদস্যরা তাদের বলেছেন পালিয়ে যেতে।
দায় রাজনৈতিক বিভাজনের
দেশে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার ক্ষমতার লড়াইয়ে আটকে আছে ২০১৪ সাল থেকে, যা নিশ্চিত বিস্ফারিত হবে। সুতরাং লিবিয়ার একার পক্ষে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব। ন্যাটোর হামলায় প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফির পতনের পর থেকেই লিবিয়া গহ্বরে পড়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও রয়েছে লিবিয়ায় দুঃখজনক ইতিহাস। ২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম লিবিয়ার দীর্ঘকালীন শাসক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির আক্রমণ থেকে বেনগাজি শহরকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে। পরে তারা ন্যাটো-নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় মিত্রদের হাতে পুনর্গঠনের ভার ছেড়ে দেয়। কিন্তু সেই চেষ্টা মাঠে মারা গেছে, ইউরোপ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে লিবিয়ায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টায়। ২০১২ সালে আল-কায়েদা অনুসারীদের হামলার মুখে বেনগাজি থেকে মার্কিনরা পিছু হটার পরই দেশের পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন দেখা দেয়। এই বিভাজন এত গভীর ক্ষত বয়ে আনে যা লিবিয়ান জনসাধারণকে চিরকালের মতো পঙ্গু করে দেয়।
অথচ দেরনা ছিল গোটা লিবিয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জলপ্রপাত এবং নীলাভ জলের জন্য বিখ্যাত। ষাটের দশকে দেরনা ছিল শিক্ষা ও শিল্পকলার কেন্দ্রভূমি। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে গাদ্দাফির শাসনামলে দেরনা কট্টরপন্থি বিরোধীদের হটস্পটে পরিণত হয়। ২০১২ সালের বেনগাজি হামলায় অংশগ্রহণকারী আল-কায়েদা অনুসারীদের বিরাট অংশ এসেছিল দেরনা থেকে। আরও বছর দুই পরে আইএস এই শহরে ইসলামি হুকুমতও প্রতিষ্ঠা করেছে। তারপর থেকে দেরনা খানিকটা পরিত্যক্ত এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবহেলিত। ফলে বাঁধের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর যতœ নেওয়া হয়নি। পুরো লিবিয়াবাসী সম্ভবত জানতেন যে, একদিন বাঁধ ভেঙে পড়বে।
তেলের দাম বৃদ্ধি
লিবিয়ায় বিপর্যয়কর বন্যার ফলে জ্বালানি বাজারে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় গত ১০ মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো মঙ্গলবার বিশ্বব্যাপী তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯২ ডলার ছাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২% ভাগ বেড়ে ব্যারেলের দাম হয়েছে ৯২.৩৮ ডলার। ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বরের পরে এটি সর্বোচ্চ মূল্য। আমেরিকায় ২.৩% বেড়ে ব্যারেলের দাম দাঁড়িয়েছে ৮৯.২৯ ডলার। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে মার্কিন অর্থনীতি জুড়ে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে। দাম বৃদ্ধির জন্য বিশ্লেষকরা লিবিয়ার বন্যাকে দায়ী করেছেন, যা অস্থায়ীভাবে ওপেকভুক্ত দেশ থেকে তেল রপ্তানি ব্যাহত করবে। কেপলারের আমেরিকার তেল বিশ্লেষক ম্যাট স্মিথ বলেছেন, দুর্যোগের ফলে লিবিয়ার বেশ কয়েকটি বন্দর বর্তমানে তেল রপ্তানির সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। যদি সৌদির মতো দেশগুলো সরবরাহ না বাড়ায় তাহলে খুব শিগগির দাম কমারও কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিশ্বসম্প্রদায়ের করণীয়
ধ্বংসের পরিমাণ এত ভয়াবহ যে, যে-কোনোও উন্নত দেশের জন্যও সামাল দেওয়া কঠিন। দুর্গত এলাকাটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সরঞ্জামের অভাব প্রকট। তাদের জরুরি আশ্রয়, খাবার, পানি এবং চিকিৎসার প্রয়োজন। যা ভেসে গেছে সেসব নতুন করে গড়ে তুলতে বিপুল প্রকৌশলী ও বাজেট দরকার। আপাতত অস্থায়ী সেতু ও রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণ করতে হবে এবং শহরের ক্ষতিগ্রস্ত বন্দরটি কার্যকর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। আটকেপড়া অধিবাসীদের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মুঠোফোন পরিষেবা এবং সমুদ্র থেকে তোলা মৃতদেহ প্যাক করতে বডিব্যাগ প্রয়োজন।
লিবিয়ায় মার্কিনরা আবার ফিরে আসতে পারে। রাজনৈতিক কারণে না হলেও জনগণের স্বার্থরক্ষায়। দেরনার বিপর্যয় সেই সুযোগ করে দিয়েছে তাদের। গত মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ত্রাণ সংস্থার মাধ্যমে লিবিয়ায় জরুরি তহবিল পাঠাবে এবং অতিরিক্ত সহায়তা প্রদানের জন্য লিবিয়ান কর্র্তৃপক্ষ এবং জাতিসংঘের সঙ্গে সমন্বয় করবে।
বিশ্বের অনেক দেশ লিবিয়ায় ত্রাণ পাঠানোকে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবছে। ত্রাণ যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের মাধ্যমে না পৌঁছানো হলে তা মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর হাতে পড়তে পারে, যা তাদের আরও শক্তিশালী করবে। তা ছাড়া কেবল স্বল্পকালীন ত্রাণসহায়তা তাদের ধ্বংসের ক্ষত থেকে উদ্ধার করতে পারবে না, দীর্ঘকালীন পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা সম্পন্ন হতে বছর লাগতে পারে। ফলে ঝুঁকির পরিমাণ আরও বেশি। তাই রাজনৈতিক বিবেচনা নাকি সহায়তা কোনটি অগ্রাধিকার পাবে, তা নিয়ে বিশ্বসম্প্রদায় দ্বিধায় রয়েছে।
বহু বছর লিবিয়াকে উপসাগরীয় অঞ্চলের সমস্যা বলে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে। এই বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে হলেও লিবিয়ার জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে বিশ্বসম্প্রদায়ের সামনে। তাদে উচিত প্রথমেই সুযোগ গ্রহণ করা এবং সবার আগে লিবিয়ানদের স্বার্থের দিকে তাকানো। বিশ্বের দীর্ঘমেয়াদি শান্তির জন্য হলেও আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
মন্তব্য করুনঃ