কোটাবিরোধী আন্দোলনের গতিধারাটা বুঝলাম না! বলতে গেলে আন্দোলনকারীদের দাবির মুখেই হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা দিয়েছেন আপিল বিভাগ ( এর আগে ৪ জুলাই হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে ‘নট টুডে ’ বলে ফেরত দিয়েছিলেন এবং প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন রাজপথে আন্দোলন করে আদালতের রায় পরিবর্তন করা যায় না)। যদিও আন্দোলনের চাপেই শেষ পর্যন্ত নট টুডে পরিবর্তন করে দ্রুত শুনানির জন্য আনা হয়, দুজন শিক্ষার্থীকে পক্ষভূক্ত করে, শুনানি করে, হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার মাসের স্থিতাবস্থা জারি করা হয়।
সর্বোচ্চ আদালত এটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমি মনে করি। এখন নিয়মিত বেঞ্চে পূর্ণাঙ্গ শুনানি হোক। সব পক্ষের বক্তব্য শোনা হবে আদালতও এটা বলেছেন। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকবে কী না, ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান নাতিপুতিসহ বংশ পরম্পরায় থাকবে কী না এটা ফয়সালা হোক।
আপিল বিভাগের আদেশের পর আন্দোলনকারীদের আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আন্দোলন স্থগিত করা ছিল বাস্তবসম্মত। কিন্তু তা না করে তারা এখনই আইন পরিবর্তন করা, না করলে ঘরে ফিরে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এটা কি ভাবে সম্ভব হবে? প্রথমত আইন পরিবর্তন করতে হলে সংসদ লাগবে এবং এর একটা প্রক্রিয়া রয়েছে। সংসদে বিল আনতে হবে। কিন্তু এখন সংসদ নেই। দ্বিতীয়ত আদালতে বিচারাধীন যে বিষয়টি সেটার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত সরকার আইন পাল্টাবে কেমনে? আন্দোলনকারীরা কী এটা বুঝতে পারছে না? এখানে গায়ের জোরের কি আছে? আন্দোলনটা এখন ভিন্ন দিকে চলে যাবে মনে হয়। এটা রাজনৈতিক আন্দোলন হয়ে যাচ্ছে। শাহবাগ মোড়ে যে ছেলেটি বক্তৃতা দিয়েছে তার বক্তব্যের মধ্যে রাজনীতির গন্ধ রয়েছে। তার ক্ষোভ যেনো ঝরে পড়ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ওপর। এটাতো মানা যাবে না।
কোটা সংস্কারের দাবি অবশ্যই যৌক্তিক। মুক্তিযোদ্ধা কোটা সন্তান পর্যন্ত থাকতে পারে। কিন্তু নাতিপুতি আর বংশ পরম্পরায় চলতে পারে না। আর ৩০ ভাগতো কোনো যুক্তিতেই হতে পারে না।
কিন্তু এই দাবিগুলো যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে তা হলে আমরা মানবো না। রাস্তাঘাট অবরোধ করে বাংলা ব্লকেডের নামে আরব বসন্ত করতে চাইলে, সরকার পতনের বাসনা থাকলে আন্দোলনকারীদের আমছালা সব যেতে পারে। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ যেনো না ভাঙে।
রাস্তা অবরোধের নামে মানুষের দুর্ভোগ বন্ধ করতে হবে।
কোটা বাতিল করে সরকারের জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছিল হাইকোর্ট। সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ তার ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেছে। চার সপ্তাহ পর সর্বোচ্চ আদালতে সব পক্ষের যুক্তিতর্ক তুলে ধরে শুনানি হবে, সেখানে নির্ধারণ হবে কোটা থাকবে কী না। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে যে ধরনের উগ্রতা দেখাচ্ছে এটা দুঃখজনক। রাস্তা বন্ধ করে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে কোনো আন্দোলন হতে পারে না। বিষয়টা বুঝতে হবে, এটা এখন সরকারের হাতে নেই, এটা আদালতের বিচার্য বিষয়। আদালতেই ফয়সালা হবে।
কিন্তু তা না করে বাংলা ব্লকেড নামে সেই ব্যার্থ আরব বসন্ত করার চেষ্টা চলছে। পেছনে বাতাস কে বা কারা দিচ্ছে এটাও স্পষ্ট।
আমার স্পষ্ট কথা কোটা থাকবে কী না সেটা সর্বোচ্চ আদালত থেকে সিদ্ধান্ত আসুক। কোটার নামে অনেক মেধা ঝরে যায়, এটা অস্বীকার করার মতো না। এ ছাড়া
মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি যে হয়েছে এটাও অস্বীকার করার মতো না।
ভুলে গেলে চলবে না দেশে সাবেক কয়েকজন সচিবও জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন, যা পরে ভূয়া প্রমাণিত হয়। সাবেক একজন মন্ত্রীও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন, আরও কয়েকজন নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন । মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরাট একটা অংশ ভূয়া এবং জালিয়াতি করে সংগ্রহ করা। প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সনদের চিন্তাও করেন নি, নেনও নি। এমন অনেক তথ্য প্রমাণ আছে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার, যারা সনদ নিয়ে রাষ্ট্র থেকে সব সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। অনেক প্রমাণ আছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন কিন্তু পরে কোনো সনদ নেননি। অনেকের মৃত্যুর পর তাদের উত্তরাধিকারীরা চেষ্টাতদ্বির করেও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে কোনো স্বীকৃতি আদায় করতে পারেন নি।
মুক্তিযোদ্ধা সনদ টাকায় বিকিকিনি হয়েছে এমন ভূরিভূরি নজির রয়েছে। কতো জাল জালিয়াতি হয়েছে তা অকল্পনীয়। মুজিবনগর কর্মচারীর নামে ভয়াবহ জালিয়াতি হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায় জালিয়াতি করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মুজিবনগর কমর্চারির নামে চাকরিতে ঢুকেছেন যে লোকগুলো তাদের বেশিরভাগেরই বয়স মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল ৫ থেকে ৬ বছর। মাতৃদুগ্ধ পানরত অবস্থায় তারা কিভাবে মুজিবনগরে চাকরি করেছেন এই প্রশ্ন তুলেনি আইন মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শতকোটি টাকা লেনদেনের মাধ্যমে এই নিয়োগ হয়।
জালিয়াতি করে চাকরিতে ঢোকা মুজিবনগর কর্মচারিরাও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়েছেন আর তাদের সন্তান নাতিপুতিরাও এই কোটার সুবিধা পাবেন। কিন্তু এদের মামলা এবং ঠিকুজী পর্যালোচনা করে দেখা যায় ভয়াবহ জালিয়াতি করে তারা সরকারি চাকরিতে ঢুকে গেছেন এবং এখনও তারা চাকরি করছেন।
কাজেই ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ বিষয়টি আরও যাচাই-বাছাই করা দরকার। শুধু আবেগ দিয়ে মেধাবীদের বঞ্চনা করা ঠিক হবে না। শুধু মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া একটা সনদই সবকিছু না। এর দ্বারা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রমাণ বহন করে না। জালিয়াতরা বরং এই সনদ দ্রুত সংগ্রহ করে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা যদি রাখতেই হয় সে ক্ষেত্রে শুধু সনদ না দেখে কয়েক স্তরে যাচাই-বাছাই করা যেতে পারে। কোটা হতে পারে শহিদ পরিবারের সন্তানদের জন্য। এ ছাড়া প্রতিবন্দী, অনগ্রসর শ্রেণির জন্য কোটাতো থাকতেই হবে।
আরেকটা বিষয়ও বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের বেশিরভাগ মানুষ অংশ নিয়েছিল। আবার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণে যারা জড়িত ছিল সেই রাজাকার আল-বদরদের এবং তাদের উত্তরসূরিদের তালিকা তৈরি করে তাদেরকে সরকারি চাকরি থেকে বাদ দেয়া যেতে পারে। তারা যাতে কোনো কালেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে না পারে সেটা আইন করে নিশ্চিত করা যেতে পারে।
শংকর মৈত্র, পরিচালক (এনসিএ), চ্যানেল এস
মন্তব্য করুনঃ