• ঢাকা
  • |
  • শনিবার ৭ই বৈশাখ ১৪৩১ সকাল ১১:০৫:১০ (20-Apr-2024)
  • - ৩৩° সে:

বাস্তিল দুর্গের পতন, জাদুকরের কব্জায় বিশ্বকাপ


সোমবার ১৯শে ডিসেম্বর ২০২২ সকাল ১১:৫৬



বাস্তিল দুর্গের পতন, জাদুকরের কব্জায় বিশ্বকাপ

ছবি : সংগৃহীত

ফুটবল যুদ্ধের বার্তা দেয় না। তবে সেটি যখন কোটি মানুষের হৃদস্পন্দনের সাথে জড়িয়ে পড়ে, সেখানেও যুদ্ধ বাঁধে- এ যুদ্ধের নাম স্নায়ুযুদ্ধ। লুসাইলের মাঠেই লাতিন ছন্দের পাল্টা প্রতিরোধে গড়ে উঠলো ফরাসিদের বাস্তিল দুর্গ। পায়ের জাদুতে তার পতন ঘটাতে হবে মেসিবাহিনীকে! আনন্দ, বিষাদ, উত্তেজনা, শঙ্কা; পেন্ডুলামের মতো দুলেছে খেলার ভাগ্য। ৩-৩ গোলের ম্যাচের পর টাইব্রেক! একজন এমিলিয়ানোর কথা রাখার পালা; জাদুকর মেসির জন্য কাপ এনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পালা। কথা রাখলেন এমিলি; জাদুকর মেসির হাতে তুলে দিলেন বিশ্বকাপ। আহ্ বিশ্বকাপ! এতই আরাধ্য যে আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে পাওয়ার আগেই চুমু এঁকে দিলেন এলএম টেন।

অথচ প্রথমার্ধে একচেটিয়া বল দখলে ছিল আলবিসেলেস্তেদের। একের পর এক ছান্দসিক আক্রমণ। কিন্তু প্রথমার্ধটা ছিল কেবলই আর্জেন্টিনার। বল দখল থেকে নিয়ে শুরু করে গোল মুখে আক্রমণ সবই করেছে মেসি-আলভারেজরা। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ মিনিটে ফরাসি বক্সে ডি মারিয়ার হানা। প্রতিরোধে পেছন থেকে ট্যাকল করলেন ডেম্বেলে। স্পট কিক থেকে আসরে নিজের ৬ষ্ঠ গোল করেন লিও।

ফুটবলে এক গোলের ভরসা নেই। কাতার বিশ্বকাপে তো আরও নেই। ব্যবধান বাড়াতে একের পর এক আক্রমণে যায় স্কালোনির শিষ্যরা। ৩৬ মিনিটে প্রতিপক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পাল্টা আক্রমণে ব্যবধান ২-০ করেন ডি মারিয়া। মেসির টোকা থেকে ফ্রান্সের ফাঁকা রক্ষণে বল থ্রু করেন আলভারেজ। সেই থ্রু ধরে ডি বক্সে ঢুকে পড়েন ম্যাকঅ্যালিস্টার। গোলরক্ষককে একা পেয়েও পোস্টে শট নেননি এই ডিফেন্ডার। গোল নিশ্চিত করতে বল বাড়িয়ে দেন ডি মারিয়ার দিকে, যাতে কোনো ভুল করেননি ৪র্থ বারের মতো বিশ্বকাপ খেলা এই ফরোয়ার্ড।

এরপরও একের পর সৃষ্টিশীল ফুটবলে সুযোগ তৈরি করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু তা প্রতিহত জমাট বাঁধতে থাকা ফরাসি দুর্গে। ২-০ ব্যবধানের বিরতিও যে নিরাপদ নয় কাতার বিশ্বকাপ তা বারবার দেখিয়েছে। আর্জেন্টিনা সমর্থকরা অন্তত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।

বিরতির পরও ফরাসিদের গুছিয়ে উঠতে সময় লেগেছে। খোলনলচে স্কোয়াড পাল্টে ফেলেন ফরাসি মাস্টারমাইন্ড দিদিয়ের দেশম। প্রথমার্ধেই তুলে নিয়েছিলেন ডেম্বেলে আর জিরুকে। দ্বিতীয়ার্ধে বদলালেন প্রধান সেনাপতি গ্রিজম্যানকেও। সাথে উঠিয়ে নিলেন ফার্নান্দেজকেও। থুরাম, কোলোমেয়ানি, কোমেন আর কামাভিঙ্গার মতো তরুণ সেনানিরা এসে ম্যাচে গতির সঞ্চার করলেন। যেন বাস্তিল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আলবিসেলেস্তেদের দিকে ছুটে যাচ্ছেন তরুণ তুর্কিরা। এরা দুর্বিনীত, এরা নত হওয়ার নয়, জয়ের নেশায় মত্ত। তরুণ সহযোদ্ধাদের পেয়েই যেন জেগে উঠলেন নিষ্প্রভ হয়ে থাকা কিলিয়ান এমবাপ্পে। তাতেই তছনছ আর্জেন্টিনার রক্ষণ।

৭৯ মিনিটে ডি বক্সের ভেতর কোলো মোয়ানিকে ফাউল করে বসেন ওটামেন্ডি। গোটা ম্যাচে যেখানে পোস্টেই শট নিতে পারছিল না ফ্রান্স। সেখানে স্পট কিক থেকে ফরাসিদের ম্যাচে ফেরান কিলিয়ান এমবাপ্পে।

মাত্র ৯৭ সেকেন্ডে পাল্টে যায় ম্যাচের গোটা চিত্র। গোল খেয়ে যেন হারিয়ে যায় আর্জেন্টিনার রক্ষণ। থুরামের ক্রস থেকে কোলো মোয়ানির চিপ ফাঁকায় দাঁড়ানো এমবাপ্পেকে খুঁজে বের করে। তুখোড় সাইড ভলিতে বল জালে পাঠিয়ে ফরাসিদের সমতায় ফেরায় কিলিয়ান এমবাপ্পে। একই সাথে ৭ গোল করে মেসিকে পেছনে ফেলে শীর্ষ গোলদাতার জায়গা দখল করে নেন এই ফ্রেঞ্চম্যান। ম্যাচ শেষে সেটি নিয়ে যান ৮-এ।

এরপর ছন্নছাড়া আলবিসেলেস্তেরা গুছিয়ে নেয়ার আগেই একের পর এক আক্রমণ হানাতে থাকে ফ্রান্স। পাল্টা আক্রমণেও গোল দেয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি মেসি বাহিনী।

অতিরিক্ত সময়েও সেই স্নায়ুযুদ্ধই। ১০৮ মিনিটে লাওতারো মার্টিনেজ বল নিয়ে ঢুকে পড়েন বক্সে। তার করা ক্রস পান মেসি। গোল লাইনের ভেতর থেকে বল ফেরানোর চেষ্টা করেন ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডার। কিন্তু প্রযুক্তি ধরিয়ে দেয় গোল।

১৯৮৬ সালে জার্মানিকে হারিয়ে যেবার শিরোপা নেয় আর্জেন্টিনা। সেবারও দুই গোলের লিড নিয়েও হারিয়েছিলো ম্যারাডোনার দল। শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলে সেবার ম্যাচ জিতে শিরোপা নিশ্চিত করেছিলো তারা।

মেসির এই গোলের পর মনে হচ্ছিলো ফিরে আসছে ১৯৮৬’র বিশ্বকাপ। তবে মাঠে যে রয়েছেন আরেক সুপারস্টার। ১১৮ মিনিটে এমবাপ্পের শট আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডারের হাত লাগলে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। স্পট কিক থেকে ১৯৬৬ সালের পর বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করে দলকে আবারও ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। একই সাথে ৮ গোল করে নিশ্চিত করে ফেলেন এবারের আসরের গোল্ডেন বুটটি।

এরপর শেষ মুহূর্তে দু’পক্ষেই গোল হতে হতেও হয়নি। ফলাফল টাইব্রেক। মার্টিনেজের কথা রাখার পালা। কথা রেখেছেন স্কালোনির সর্বশেষ সেনাপতি। ৪-২ ব্যবধানে জয় আর্জেন্টিনার। ভামোস, ভামোস ধ্বনিতে প্রকম্পিত স্টেডিয়াম, দেশ-দেশান্তর, রোজারিও থেকে কুড়িগ্রাম। স্বপ্নের বিশ্বকাপ নিজের কব্জায় পেলেন জাদুকর মেসি। সাথে অবধারিত হয়ে ওঠা গোল্ডেন বলটিও। আর এমি যে গোল্ডেন গ্লাভস জোড়া নিজের করে নেবেন সেই ইতিহাস যেন লেখা হয়ে গিয়েছিল আগেই।

মন্তব্য করুনঃ


সর্বশেষ সংবাদ