ঠাকুরগাঁওয়ে চা-চাষে অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। ফলে এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য চা বাগান। চা-চাষে সাফল্য পাওয়া পঞ্চগড়ের পার্শ্ববর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও। চা-শিল্পের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে সীমান্তঘেঁষে গড়ে ওঠা দিগন্ত বিস্তৃত এ জেলার চা-বাগানে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চায়ের আবাদ শুরু হয়েছে ঠাকুরগাঁও জেলার প্রতিটি উপজেলার গ্রামে গ্রামে। বিভিন্ন জেলা ঘুরে দেখা মেলে সমতলভূমিতে গড়ে তোলা ছোট-বড় অসংখ্য চা-বাগানের। বসতবাড়ির পেছনের জমিতে, বাড়ির আঙিনার আশপাশে, রাস্তার পাশে-আনাচকানাচে এখন চা-গাছের সমারোহ।
চা-শিল্পে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন ঠাকুরগাঁও জেলার চাষিরা। একসময় যে জমিতে আগাছা ছাড়া কোনো ফসল হতো না, সেই জমিতে এখন চা-গাছের বাড়বাড়ন্ত। নদীর ধারে যেসব জমি শুধু গোচারণ ভূমি হিসেবে পড়ে থাকত, সেই দিগন্তবিস্তৃত জমিও চা-চাষের সবুজ লীলাভূমিতে পরিণত হচ্ছে।
জানা গেছে, অন্যান্য ফসলের তুলনায় চাষিরা চায়ে লাভবান হওয়ায় দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে জেলায় চা-চাষ। এতে চা অর্থকরী ফসল হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছে এ জেলায়। এসব বাগানে কাজ করে স্থানীয় অনেক বেকারও পেয়েছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় জরিপ চালায় বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং চা গবেষণা ইনস্টিটিউট। ২০০০ সালের দিকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা-চাষ শুরু হয়। পরে ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় প্রথম চা-চাষ শুরু হয়। এখন ঠাকুরগাঁও জেলার প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামে চা-চাষ হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ঠাকুরগাঁও জেলায় মোট ২৪১.৭১ হেক্টর জমিতে করা হয়েছে চায়ের বাগান। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় ৫৭.৭২ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় মিলিয়ে ৯৩টি চা-বাগান রয়েছে।
পীরগঞ্জ উপজেলায় ০.৩৯ হেক্টর জমিতে ১টি, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় ১৭৯ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় মোট ১০০টি, রাণীশংকৈল উপজেলায় ১ হেক্টর জমিতে ৪টি ও হরিপুর উপজেলায় ৩.৬ হেক্টর জমিতে ৩টি চা-বাগান রয়েছে।
সব থেকে বেশি চা-চাষ করা হয়েছে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায়। এই উপজেলায় ১৭৯ হেক্টর জমিতে চা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে রনবাগ ও বেউরঝাড়ী সীমান্ত ফাঁড়ির কাছে অবস্থিত দুমুখা এবং কলশির মুখে ইসলাম টি এস্টেট নামে মোট ৩টি বাগানে ১৩৩ একর জমিতে চা চাষ করা হয়েছে। এসব বাগানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
ইসলাম টি এস্টেটের ম্যানেজার এ কে এম শামসুজ্জামান (বাবলু) বলেন, ৩টি বাগান থেকে গত বছর ১৫ লাখ কেজি চা-পাতা সংগ্রহ করা হয়েছে। এবার এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ কেজি পাতা সংগ্রহ করেছি। আশা করছি পুরো বছরে এবারও ১৫ লাখ কেজি পাতা সংগ্রহ হবে। এ বাগানের চা-পাতাগুলো সংগ্রহ করে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় পঞ্চগড়ের সাজেদা রফিক টি ফ্যাক্টরিতে।
১১ বছর ধরে চা-বাগানে কাজ করছেন সুবল চন্দ্রপাল। তিনি বলেন, আগে কাজ পাইতাম না। সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ১১ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। এখানে কাজ করে যা পাই তা দিয়ে মোটামুটি সংসার ভালোই চলে। বাগানে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করে ২৪০ টাকা পাই। পরে আবার ওভারটাইম করলে বা চা-পাতা কাটলে কোনো দিন ৫০০ টাকাও দিন হাজিরা পাই।
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বেউরঝাড়ী গ্রামের কৃষক কলিম উদ্দিন দেড় বছর আগে বাড়ির পেছনে ৬ বিঘা জমিতে করেছেন চা-বাগান। এবার চা-পাতার কেজি ১৪-১৫ টাকা দামে বিক্রি করলেও ৬ বিঘা জমির এক রাউন্ড চা-পাতা বিক্রি করেছেন ২৩ হজার টাকায়। তবে তার অভিযোগ, সিন্ডিকেটের কারণে চা-চাষিরা চা-পাতার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। প্রতি ১০০ কেজি চা-পাতায় ২০ কেজি পাতা বেশি দেয়া লাগে।
বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তের নিটোলডোবা গ্রামে গ্রিন ফিল্ড টি এস্টেট ২০০৭ সালে ৬০ একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। পরে ২০১৭ সালে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার শাহবাজপুরে ‘গ্রিন ফিল্ড টি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামে একটি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তোলেন ফয়জুল ইসলাম (হিরু)।
নিটোলডোবায় সরেজমিন দেখা যায়, নাগর নদীর এপারে ও ওপারে চায়ের গাছ। এ যেন প্রকৃতিতে কেউ সবুজের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। সবুজের এ গালিচা আর অন্য কিছু নয়, দিগন্তবিস্তৃত চায়ের বাগান। বাগানের গাছ থেকে চা-পাতা তুলছিলেন বেদেনা, হাসেনাসহ আরো ৩-৪ জন। তারা বলেন, এখানে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করে ১০০ টাকা হাজিরা পাওয়া যায়। ১টার পর থেকে কাজ করলে ওভারটাইম হিসেবে আরো বেশি টাকা পাই। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এদিকে তেমন কাজ পাওয়া যায় না। তাই বাড়িতে বসে না থেকে বাগানে কাজ করি।
নয় বছর ধরে গ্রিন ফিল্ড টি এস্টেট চা বাগানের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন তাজমুল হক। তিনি বলেন, গত বছর এ বাগান থেকে ৫ লাখ কেজির বেশি চা-পাতা সংগ্রহ করেছি। গত বছরের তুলনায় এবার আরো বেশি চা-পাতা সংগ্রহ করতে পারবো বলে আশা করছি। এছাড়া এলাকায় দিন দিন চা-চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে ঠাকুরগাঁও।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর ভাঙনের ফলে চা-বাগান নদীতে চলে যাচ্ছে। নদীভাঙন রোধে সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করলে আমাদের কোম্পানি ও এখানে যারা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের জন্য ভালো হতো। কারণ এখানে চা-বাগান আছে বলেই অনেকে কাজ করতে পারছেন। কিন্তু যদি দিন দিন নদীভাঙনে বাগান বিলীন হয়ে হয়ে যায়, তাহলে এখানে যারা কাজ করছেন তারা বেকার হয়ে পড়বেন।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের যুবক মো. মোস্তাফিজুর রহমান। ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স পাস করে বসে না থেকে বাড়িতে শুরু করেছেন কৃষিকাজ। অন্যান্য ফসল চাষাবাদের পাশাপাশি পতিত ৩৩ শতক জমিতে করেছেন চা-বাগান।
তিনি বলেন, এলাকার অনেক মানুষ চা-বাগান করে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও পরীক্ষামূলকভাবে ৩৩ শতক জমিতে চা-চাষ শুরু করেছি। ফলন ও দাম পেলে আরো বেশি জমিতে চাষ করবো। সরকার ঠাকুরগাঁও জেলায় চা বোর্ড ও চা প্রক্রিয়াকরণের জন্য কারখানা করে, তাহলে চায়ের জন্য বিখ্যাত ও সমৃদ্ধ হবে ঠাকুরগাঁও।
ঠাকুরগাঁও জজকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জাহিদ ইকবাল। তেঁতুলিয়ায় তার এক সহকর্মীকে চা-চাষ করতে দেখে তিনিও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লাহিড়ী শাহবাজপুরে ২০১৮ সালে ৩ একর জমিতে টিভি-২৬ জাতের চা-চাষ শুরু করেছেন। সেই বাগান থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার কেজি চা-পাতা উত্তোলন করেছেন তিনি, দামও পেয়েছেন ভালো।
সাংবাদিকদের বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলায় চা-চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সরকারিভাবে চাষিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও ঠাকুরগাঁও জেলায় চা বোর্ডের অফিস করা হয়, চা-পাতার দাম নিয়ন্ত্রণে কমিটি গঠন করা হয়, তাহলে ঠাকুরগাঁও জেলায় উন্নতমানের ব্যাপক চা উৎপাদন করা সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে এ পর্যন্ত চা-পাতার দাম কমে যাওয়ায় চা-চাষিদের অবস্থা বেশি ভালো নেই। বাজারে চা কিনতে গেলে দাম বেশি আর চা-পাতা বিক্রি করতে গেলে দাম কম।
তিনি বলেন, এখানে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেট রোধে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ক্ষুদ্র চা-চাষি মেহেদি আহসান উল্লাহ জানান, সরকারি উদ্যোগে কারখানা স্থাপন এবং চা-চাষে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা নিলে এ এলাকায় চায়ের চাষ আরো সম্প্রসারিত হবে।
অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ছোট ছোট বাগান গড়ে তুলেছেন অসংখ্য চাষি। যেমন - পীরগঞ্জ উপজেলার বৈরচুনা গ্রামে ৬৬ শতক জমিতে চা বাগান করেছেন শাহিনুর রহমান, রাণীশংকৈল উপজেলার ঈশ্বরচন্দ্র, সফিকুল ইসলাম, খালেক, আলমগীর। হরিপুর উপজেলার তোফাজ্জল হোসেন, শওকত আলী, আবু তাহের - এই ৩ চাষি ৩.৬ হেক্টর জমিতে করেছেন চায়ের বাগান। এছাড়া ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ৮৫ জন ৫৭.৭২ হেক্টর জমিতে ৯৩টি বাগান করেছেন।
ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আবু হোসেন বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলার ভৌগোলিক ও ভূমি অবস্থান ভালো। এখানকার মাটি যেমন অন্যান্য ফসলের জন্য অত্যন্ত উপযোগী, তেমনি চায়ের জন্যও উপযোগী। তবে যে জমিগুলো বেশি উর্বর ও অন্যান্য ফসল ভালো ফলে, সেই জমিগুলো বাদ দিয়ে যদি নদী অববাহিকা ও যেগুলো জমিতে অন্যান্য ফসল ভালো হয় না, সেই জমিতে চা-চাষ করা হয়, তাহলে কৃষকরা বেশি লাভবান হবেন। তাছাড়া চা বোর্ড যদি চা-চাষিদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা, বাজারজাতকরণসহ অন্যান্য বিষয় নিশ্চিত করে, তাহলে ঠাকুরগাঁও জেলায় চা হবে গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল।
চা প্রক্রিয়াজাকরণ ফ্যাক্টরি মালিকদের সঙ্গে চাষিদের সমন্বয় করে চা-চাষ করার পরামর্শের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষকরা যাতে চা-পাতা যথাযথ মূল্যে বিক্রি করতে পারেন, সেটি চা বোর্ডকে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে কৃষকরা লাভবান হবেন। কৃষি বিভাগ থেকে চা-গাছের পরিচর্যা, সার ও বালাইনাশক ব্যবহারে সার্বিক পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।
ঠাকুরগাঁও জেলায় চা শিল্পের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল বলে জানান জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলায় চা বোর্ড অফিস স্থাপনের জন্য জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি একটি আবেদন করেছিলাম। তবে এখনই ঠাকুরগাঁও জেলায় চা বোর্ড স্থাপন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে কেউ যদি ব্যক্তি মালিকানায় চা ফ্যাক্টরি করতে চায় তাহলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হবে।
মন্তব্য করুনঃ